সফল হতে গেলে 'প্রয়োজনীয়তা' এর গুরুত্ব জানা খুব প্রয়োজন (Importance of "Essentialism" ):-

 

প্রয়োজনীয় বিষয় বা বস্তুর গুরুত্ব জানুন :-

সফল ব্যক্তি এবং অসফল ব্যক্তির মধ্যে একটি বিশেষ পার্থক্য আছে। কিছু   ব্যক্তি সবকিছুতেই হ্যাঁ বলেন, অর্থাৎ একসাথে অনেকগুলি কাজ করার পরিকল্পনা নিয়ে ফেলেন যার ফলে কোনোটিই ভালোভাবে সম্পন্ন হয়ে ওঠে না। লোক লাজেই হোক বা মান সম্মান রক্ষার তাগিদে হোক যা করতে বলা হবে তাতেই হ্যাঁ বলবেন এমন টি দরকার নেই। আপনি কি  করতে চান বা কি করতে চান না, সবকিছুতে বুঝে শুনে সিদ্ধান্ত নিয়ে রাজি হতে হবে অথবা প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করতে হবে। এটা নির্ণয় নেওয়ার ক্ষমতা এবং সাহস হওয়া জরুরি।

সফল ব্যক্তি এটাই করেন,  তিনি যা করতে চান তাতে "হ্যাঁ" বলবেন এবং যা করতে চান না তাতে "না" বলবেন। যা সঠিক তাতে হ্যাঁ বলবেন,  এবং যা উচিত হবে না তাতে না বলবেন। এই জন্যেই তাঁরা সফল। হ্যাঁ বা না সঠিক জায়গায় সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার আছে। ইনভেস্টিং দুনিয়া" র রাজা ওয়ারেন বাফেট বলেন "জীবনে অনেক সুযোগ পেয়েছি, বড় বড়  সুযোগ পেয়েছি , কিন্তু আমার  যা উদ্দেশ্য, সেটা ছাড়া সবকিছু কে না করে দিয়েছি।"

একটি জিনিস মনে রাখবেন, আপনার জীবনে কি করবেন তার সিদ্ধান্ত আপনাকেই নিতে হবে, আপনি কি চান,  কি হতে চান,  কি করতে চান, সেটা সবথেকে ভালো আপনি জানেন,  তাই আপনার জীবনের ধারক এবং বাহক আপনি নিজে হন। কোনটা করবেন আর কোনটা বর্জন করবেন তার সিদ্ধান্ত নিজেই নিন।

একটা ব্লকবাস্টার চলচিত্র যা অস্কার পায়, সেই চালচিত্র মুক্তি পাওয়ার আগে, চলচিত্র নির্মাণের সময় অনেকবার কাটছাঁট করা হয়। কারণ চলচিত্র টি নির্মাণ করার যা উদ্দেশ্য তা যেন দর্শক দেখে ভালোভাবে বুঝতে পারেন। সেই জন্য চলচিত্রের সেই অংশ কেটে দেন যা অতটা গুরুত্বপূর্ণ নয়।

আজকে দৈনন্দিন জীবনে ব্যস্ত জীবন এতটাই স্টেটাস সিম্বল হয়ে গেছে যে অনেকে বুঝেন কঠোর পরিশ্রম করলেই সফলতা লাভ করা যায়। অনেকে ব্যস্ত থাকাটাকে কঠোর পরিশ্রম বলে মনে করেন,  এবং যে কোনো কাজ কে নিজের কাজের তালিকায় যোগ করে নেন। কঠোর পরিশ্রম অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু ভুল কাজে বা ভুল পথে কঠোর পরিশ্রম করলে অসফলতা নিয়ে আসে,  এবং অযথা মূল্যবান সময় নষ্ট হয়। উদাহরণ  স্বরূপ যদি কোনো ব্যক্তি নির্দিষ্ট জায়গা থেকে চারদিকে মোট চার কিলোমিটার যান তাহলে ব্যক্তি গেলেন, চার কিলোমিটার কিন্তু শেষে দেখাগেলো তিনি শুরু স্থল থেকে শেষ স্থল এর মোট দূরত্ব মাত্র এক কিলোমিটার রয়েছে। অপরদিকে একজন ব্যক্তি যদি একই দিকে চার কিলোমিটার যান তাহলে দেখা যাবে তাঁর শুরুস্থল থেকে শেষস্থল এর দূরত্ব চার কিলোমিটার হয়েছে অর্থাৎ দ্বিতীয় ব্যক্তি বেশি দূরত্ব যেতে পেরেছেন, কারণ তিনি একই দিকে গিয়েছেন, তিনি বারবার দিক পৰিবৰ্তন করেন নি। এই দুই ক্ষেত্রে প্রযুক্ত পরিশ্রম সমান হলেও দ্বিতীয় ক্ষেত্রে বেশি দূরত্ব যাওয়া সম্ভব হলো।

 এমনি ভাবে কাজ করবার সময় একটা উদ্দেশ্যে একবারে কাজ করছেন অথবা অনেকগুলি উদ্দেশ্যে কাজ করছেন তার উপর নির্ভর করবে আপনি কোন কাজে কতটা এগোতে পারবেন। কারণ আপনি যে কাজটি তে বেশি সময় এবং মানসিক শক্তি প্রয়োগ করবেন সেই কাজটিই বেশি এগোবে। সবসময় ব্যস্ত থাকার অর্থ এই নয় যে আপনি খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছেন। একটু গভীর ভাবে ভেবে দেখবেন যে সব কাজগুলোকে  আপনি গুরুত্বপূর্ণ ভাবছেন, সব কাজই গুরুত্বপূর্ণ নাও হাতে পারে। Pareto  র সূত্র তো বলেই দেয় যে আপনার 80 % সফলতা আপনার করা 20 % কাজ থেকে আসে। আর বাকি 20 % সফলতা বাকি 80% করা কাজ থেকে আসে। তাই সর্বদা ব্যস্ততার অর্থ এই নয় যে সবসময় দরকারি কাজ করছেন। বেশির ভাগ লোক সবসময় ব্যস্ত থেকে 80  % কাজ করেন যা 20 % ফল দেয়।

 

এর ফলে তিনি যতই পরিশ্রম করুন না কেন, খুব ভালো ফল করতে পারেন না এবং যার ফলে ওই কাজ করতে ছেড়ে দেন। পরিশ্রম তো সবাই করেন কিন্তু সেই কাজটিই  আপনাকে বেশি ফল দেবে যেটি আপনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ এবং যে কাজ আপনার উদ্দেশ্য কে পূরণ করবে।

উদাহরণ স্বরূপ বাড়ির লিফ্ট এর সঠিক বাটন টিপলে লিফ্ট উপরে আসে,  অন্য যে কোনো বাটন  টিপলে আসবে না। তেমনি উপরে উঠে আসতে হলে সঠিক কাজ করতে হবে। যেটা প্রয়োজনীয়  কাজ সেটা করতে হবে। যাতে 20% কাজ করে 80 % ফল লাভ হয়। “Essentialism “ হলো এমন একটি ধারাবাহিক কাজের পদ্ধতি যা আপনার সময় এবং মানসিক শক্তি কে কোন জায়গায় নিয়োগ করবেন সেটা শেখায়। সবথেকে আগে এটা বুঝা দরকার যে আপনি সময় এবং মানসিক শক্তির ব্যবসা করছেন। যখন আপনি একটি কাজের জন্য হ্যাঁ করবেন বলে নির্ণয় করেছেন তখন আপনি জেনে নিন সেই সময় আপনি অন্য  কাজ করবেন না। অর্থাৎ না জেনেও অন্য কোনো কাজ কে আপনি না বলেছেন।

ধরুন আপনার বন্ধু আপনাকে সিনেমা দেখার জন্য ডাকলো এবং আপনি তাঁকে হ্যাঁ বললেন। সেই সময় আপনি বাড়ির অন্য কিছু কাজ বাদ দিয়ে নিশ্চই চলচিত্র দেখতে যাচ্ছেন তাহলে বাড়ির সেই গুরুত্বপূর্ণ কাজ কে আপনি না বললেন।

যদি আপনার সময় এবং আপনার মানসিক শক্তি আপনি নিজে ব্যবহার না করতে পারেন তাহলে আপনার নয় সেটাকে অন্য কেও ব্যবহার করবে। সেই জন্য যেটা গুরুত্বপূর্ণ নয় বা যে কাজটি দরকারি নয় সেটি আপনি করবেন না, তা বলতে শিখতে হবে।

                                                                  


আপনার ক্ষেত্রে অনেকবার হয়ত হয়েছে আপনি কোনো ব্যক্তি কে না বলতে চেয়েছেন কিন্তু শুধু যাতে বিশ্বাস এ আঘাত না লাগে সেই জন্য সেই কাজে রাজি হয়েছেন, এবং সেই নির্ণয় এর পরিনাম এতো খারাপ  হয়েছে যে তার জন্য আপনাকে অনুশোচনা করতে হয়েছে। 

কখনো কখনো কাওকে না বলাটা আপনাকে কঠিন মনে হাতে পারে, কারণ ভয় থাকে হয়ত আপনার সম্পর্ক ভেঙে যেতে পারে , কিন্তু মোদ্দা কথা হলো আপনি যদি প্রভাব শালী ব্যক্তি হাতে চান তাহলে প্রয়োজনে "না" বলতে শিখতে হবে।

 কাউকে  "না" বললে হয়ত আপনি কিছুক্ষণের জন্য জনপ্রিয়তা হারাবেন, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি ক্ষেত্রে আপনার লাভ হবে। মানে রাখবেন যখন আপনি কারো কাজ কে "না" করছেন তখন আপনি শুধু ওই কাজকে না করছেন, ওই ব্যক্তি কে নয়। 

 

প্রয়োজনে কাওকে না বলার জন্য আপনি নিচের তিনটি পদ্ধতি ব্যবহার করতে পারেন :-

1)Artificial  delay  :- কাউকে "না" বলার জন্য যদি দ্বিধা হচ্ছে তাহলে "না" বলার আগে সময় নিন। নকল বাহানা করে "না" বলা কে দেরি করুন। বলুন আজকে ব্যস্ত আছি কালকে ভেবে বলবো।

2)Suggest  someone  else :- যদি দেখছেন  আপনি বিষয়টি তে আগ্রহী নন, কিন্তু  অন্য্ কেও বিষয়টি ভালোভাবে করতে পারবেন,  অথবা অন্য কেও ভালো পরামর্শ দিতে পারবেন,  তাহলে তাঁকে ওই বিশিষ্ট ব্যক্তি কে ব্যবহার করার জন্য পরামর্শ দিন।

সবকিছু কে না বলতে হবে এমন নয়। যেটাকে আপনার প্রয়োজন নয় সেটাকে না বলুন। যাতে আপনি আপনার জন্য যেটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ সেটাকে বেশি সময় দিতে পারেন। যখন আপনি আপনার গুরুত্বপূর্ণ কাজকে করতে থাকবেন, দেখবেন ওই ক্ষেত্রে আপনি সফল হাতে থাকবেন,  এবং এগিয়ে যেতে থাকবেন। আপনি বড় বড় সুযোগ ব্যবহার করার সময় পাবেন এবং বেশি লোক আপনার সাথে যুক্ত হতে   থাকবে। কিন্তু যদি আপনি প্রয়োজনীয় এবং অপ্রয়োজনীয় বিষয় কে ঠিকমতো ব্যবহার বা বর্জন করতে না পারেন,  তাহলে তা আপনার জন্য বিফলতা ডেকে নিয়ে আসতে পারে।

 3)Set  Boundaries :-বেড়া দেওয়া খুবই প্রয়োজন। ধরুন কখনো এমন হয় যে আপনি ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। আপনি জানেন আপনার সিদ্ধান্ত ভুল। এক্ষেত্রে অনেকে কি করেন তিনি জেনে গেছেন যে ভুল করেছেন তখন ভাবেন যদিও কাজটি গুরুত্বপূর্ণ নয় তবু যখন কাজটি নিয়েই নিয়েছি তখন কাজটি সম্পন্ন করে দিই । এরকম সিদ্ধান্ত আপনাকে অযথা সময় নষ্ট করতে এবং মানসিক শক্তি নষ্ট করতে প্রেরিত  করে। 3০০ টাকা দিয়ে ধরুন আপনি একটি সিনেমা টিকেট কিনেছেন। কিন্তু জানতে পারলেন চলচিত্রটি একদম ভালো নয়। দেখতে যাওয়াটা অর্থহীন হবে। এবার আপনি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন"টিকেট যখন নিয়েই ফেলেছি তখন যেমনি হোক দেখে নিই, তিন ঘন্টার তো ব্যাপার।" এবার আপনি দ্বিতীয় স্তরে ভুল করলেন। প্রথম স্তরে টিকেট কেটে তো ভুল হয়েছেই, তবু কাজটি সম্পূর্ণ করতে গিয়ে দ্বিতীয় স্তরে অর্থাৎ তিন ঘন্টা সময় নষ্ট করার সিদ্ধান্ত নিলেন। অর্থাৎ এবার আপনার টাকা এবং সময় দুটোই নষ্ট হলো।

এই sink -cost  -Policy থেকে বাঁচতে গেলে আপনাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে 3০০ টাকা দিয়ে টিকেট কেটে ভুল হয়েছে তো হয়েছে এবার সময় নষ্ট করে দ্বিতীয় ভুলটা করবো না।

এই জন্য কি করবেন, বা কি করবেন না, তার সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

যেমন- অফিস এর কাজ অফিসেই করুন। কারণ আপনার ছেলেমেয়ের যখন অফিস এ যাওয়ার অনুমতি নেই তখন আপনার অফিস এর কাজ বাড়িতে ঢোকার অনুমতি পাবে কোনো ? "Essentialism" রকম একটা বেড়া তৈরি করে বিষাক্ত লোক থেকে দূরে থাকুন। অপ্রয়োজনীয় কাজ কে "না" বলে দেন।

"Decision " শব্দ টি ল্যাটিন শব্দ থেকে এসেছে যার অর্থ হলো ছেঁটে ফেলা। যখন আপনি একটি কাজকে করবেন বলে "হ্যাঁ" বলেন তখন অন্য কাজকে আপনি করবেন না বলে ছেঁটে ফেলেন।

 ওয়ারেন বাফেট,  নরেন্দ্র মোদী,  থেকে শুরু করে জ্যাক মা,  স্টিভ জবস,  এলোন  মাস্ক, ইত্যাদি বিশ্বের মহান ব্যক্তিরা একটা মহৎ উদ্দেশ্যে নিজের জীবন অতিবাহিত করেন। জীবনে সব জিনিস এর গুরুত্ব সমান নয়,  তাই নিজেই  জীবনের পরিচালক হয়ে অপ্রয়োজনীয় কাজ গুলিকে  ছেঁটে ফেলে প্রয়োজনীয় কাজগুলিই করতে হবে, যাতে গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য বেশি সময় দেওয়া সম্ভব হয়। কোনো অপ্রয়োজনীয় বস্তু বা ব্যক্তি কে "না" বলতে শিখুন, যাতে প্রয়োজনীয় বিষয় কে "হ্যাঁ" বলতে পারেন।

 আপনার জীবনে কিছু মূল্য ,কিছু সিদ্ধান্ত,  স্থির রাখুন যা আপনার বেড়ার মতো কাজ করবে। এবং বাহ্যিক খারাপ লোক, অপ্রয়োজনীয় লোকঅপ্রয়োজনীয় কাজ থেকে দূরে থাকতে সাহায্য করবে।  

    

 সারবস্তু বিখ্যাত লেখক, বক্তা এবং বাণিজ্য উপদেষ্টা "Greg Mckeown" এর লেখা বই "Essentialism" থেকে  গৃহীত , বইটি তে অনেককিছু জানার আছে, বইটি অবশ্যই পড়বেন।


Post a Comment

0 Comments